পাঠ্যবইয়ে কি ঢুকলো আর কি বের হলো (৩)
(দ্বিতীয় পর্বের পর)
বর্তমানে যে পাঠ্যপুস্তক চলছে তার সাথে তার আগের পাঠ্যপুস্তক (২০১০-২০১১ সালের পাঠ্যপুস্তক) মিলালে বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে কি প্রবেশ করানো হয়েছে এবং কি বের করে দেওয়া হয়েছে সেটা নির্ণয় করা সম্ভব। আসুন বিষয়গুলো দেখি
ক্লাস-৮, বাংলা বই:
প্রথমেই বাদ দেওয়া হয়েছে মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটি। কবিতাটি বইয়ের কবিতার সর্বপ্রথমে ছিলো। কবিতার পাঠপরিচিতি এরকম-
“কবি এ কবিতায় স্রষ্টার অপার মহিমার কথা বর্ণনা করে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়েছেন। কবি ভক্তি বা প্রশংসা করতে না জেনেও কেবল চোখের জলে নিজেকে নিবেদন করেন। বিপদে আপদে সুখে দুঃখে শান্তিতে তিনি স্রষ্টার কাছ থেকে শক্তি কামনা করেন।”
এই কবিতাটি বদলে কবিতার লিস্টে প্রথমেই প্রবেশ করানো হয়েছে বাউল লালনের লেখা ‘মানবধর্ম’ নামক একটি কবিতা।কবিতার পাঠ পরিচিতি এরকম-
“এই পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে সক্ষম হবে যে, ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচিতির চেয়ে মানুষ হিসেবে পরিচয়টাই বড়। তারা জাত-পাত বা ধর্ম নিয়ে বাড়বাড়ি বা মিথ্যে গর্ব করা থেকে বিরত হবে”। (ক্লাস-৮, বাংলা বই, পৃষ্ঠা: ৭১)
পাঠক ! দুটো পাঠ পরিচিতি তুলনা করলেই বুঝবেন, আগে দেওয়া হতো সৃষ্টিকর্তা বা আস্তিক্যবাদ শিক্ষা, আর এখন স্পষ্ট শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ শিক্ষা।
এছাড়া ৮ম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে বা দেওয়া হয়েছে ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ নামক কবিতাটি। একটি বিষয় সিলেবাদ পর্যবেক্ষণে বোঝা গেছে- গোটা সিলেবাস থেকে মোঘলদের সমস্ত ইতিহাসগুলো বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য ভারতে মোদি সরকার আসার পর উগ্রহিন্দুরা আন্দোলন করেছে, যেন ভারতের সমস্ত স্থান থেকে মোঘলদের প্রশংসাসূচক ইতিহাস বাদ দেওয়ার জন্য এবং মোঘল বাদশাহদের নামে রাস্তা-শহরের নাম পরিবর্তন করার জন্য। মোঘলদের কোন ইতিহাস যদি সংযুক্ত করতেই হয় তবে তা করা হয়েছে বিকৃত করে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ভারতে হিন্দুরা যে বিষয়টি আন্দোলন করে জারি করেছে, বাংলাদেশে সেটা ঘটে গেছে অনেকটা বাধাহীন তথা চুপিসারেই।
দুটো পাঠ্যবই যাচাই করে দেখা গেছে, আগে অষ্টম শ্রেনীর বাংলা বইয়ে মোট গদ্য-পদ্য ছিলো ৩২টি। যার অধিকাংশ শিক্ষণীয় এবং ইতিহাস ভিত্তিক। আর এখন আছে ২২টি, অর্থাৎ আগের তুলনায় ১০টি কম। আর যেগুলো দেওয়া হয়েছে তাও ইতিহাস ও দলিল নির্ভর নয়।
ক্লাস-৯ম-১০ম, বাংলা বই:
১) সর্ব প্রথম বাদ দেওয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ কবিতাটি। আজকাল অনেকেই দাবি করে- মুসলমানদের তো আদিকালে কোন কবি-সাহিত্যিক নেই। কিন্তু এ পাঠ্যবইয়ের এ কবিতাটি থাকলে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তত বলতে পারতো ১৪-১৫শ’ শতকে মুসলমানদের মধ্যে এতজ্ঞানপূর্ণ কবি ছিলো।
‘বন্দনা’ কবিতাটিতে কবি মা-বাবা ঋণ শোধ করা যাবে না, তাই তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। মা-বাবার সাথে সাথে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সর্বপরি স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। এটা অবশ্যই নৈতিক শিক্ষা তথা আবশ্যিক শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত।
এই কবিতাটির বদলে নতুন বইয়ের প্রথমে প্রবেশ করেছে জ্ঞান দাসের লেখা ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর’ নামক কবিতাটি, যা মধ্যযুগীয় বৈষ্ণবপদাবলী। অর্থাৎ হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণেল লীলা কীর্তণ। উল্লেখ্য রাধা ছিলো মামী আর কৃষ্ণ ছিলো ভাগিনা। এ মামা-ভাগীনা মধ্যে অবৈধ সম্পর্কে বর্ণনা এখন মুসলিম দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ের শুরুতেই পড়তে হচ্ছে।
২) এরপর বাদ দেওয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি ‘আলাউল’ এর ‘হামদ’ নামক কবিতাটি। কবিতাটি এরকম-
“বিছমিল্লা প্রভুর নাম আরম্ভ প্রথম
আদ্যমূল শির সেই শোভিত উত্তম
প্রথমে প্রণাম করি এক করতার
যেই প্রভু জীবদানে স্থাপিল সংসার”
অর্থাৎ স্রষ্টার প্রশংসা সূচক কবিতা।
এই কবিতাটির বদলে প্রবেশ করানো হয়েছে মধ্যযুগের হিন্দু কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’ নামক একটি কবিতা। কবিতাটি হিন্দুদের পবিত্র মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভূক্ত। কবিতাটি মূলত হিন্দুদের দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসাসূচক এবং দেবীর কাছে প্রার্থনা করার কবিতা। কবিতাটি এরকম-
“আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে (কাশী হিন্দুদের তীর্থস্থান)
চৈত্র মাসে মোর পূজা শুক্ল অষ্টমীতে।
..............প্রণমিয়া পাটুনি (মাঝি) কহিছে জোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধে ভাতে থাকিবে তোমার সন্তান”
অর্থাৎ দেবী অন্নপূর্ণার পূজার বর্ণনা এবং আর্শিবাদ প্রার্থনা করা হচ্ছে।
বিষয়টি একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন-
যে কবিতার শুরু হলো ‘বিছমিল্লা’ দিয়ে সেটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং তার বদলে এমন কবিতা দেওয়া হয়েছে তার শুরু হয়েছে ‘অন্নপূর্ণা’ দিয়ে, মানে হিন্দুদের দেবীর নাম দিয়ে। (চলবে)

No comments