৫২ ভাষা আন্দোলনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথিত অবদান ও ভাষা সৈনিক অলি আহাদের বিবৃতি
ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে হিন্দু ও নাস্তিকদের একমাত্র অবলম্বন হলো ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক এক সাম্প্রদায়িক হিন্দু। বিশেষ করে হিন্দুরা তাকে ভাষা আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে দাবি করে থাকে, কিন্তু ভাষা সৈনিকদের মন্তব্যই প্রমাণ করে এই দাবি মিথ্যা। ভাষা সৈনিক অলি আহাদের রচিত “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫” বইতে ধীরেন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে-
“এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে শরৎ বোস-সোহরাওয়ার্দি-আবুল হাশিম-কিরন শঙ্কর রায়- জোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এর অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের বিরুদ্ধে গান্ধী-প্যাটেল-নেহেরু-শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীন অখন্ড বঙ্গের স্থলে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই তাদের অসাম্প্রদায়িকতা-এটাই তাদের বাংগালীত্ব। একমাত্র বাবু কিরণ শংকর রায় ব্যতীত কমরেড জ্যোতিবোস সহ Bengal Legislative Assembly এর সব হিন্দু সদস্যই ছিলেন চরম সাম্প্রাদিয়ক ও হিন্দু পশ্চিম বঙ্গ প্রতিষ্ঠার মুল হোতা। সাম্প্রদায়িক হিন্দু এমএলএ দের কারণে পূর্ব বাংলার ৫০/৬০ লক্ষ হিন্দু নিজ ভিটা মাটি ছেড়ে বাস্তহারা পরিচয়ে হিন্দু স্থানে হিজরত করে অমানবিক-অসামাজিক জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে।” (সূত্র: জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা ২৮)
অর্থাৎ যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র আট মাস আগে (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে বক্তব্য দেয় ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী) দুই বাংলাভাষী এলাকাকে পৃথক করার জন্য ভোট দিলো, তারই আবার কিনা বাংলা ভাষার জন্য দরদ উথলে উঠলো !! এটা কি মায়া,নাকি সদ্য তৈরী হওয়া মুসলমান রাষ্ট্রটির মধ্যে বিভেদ তৈরীর প্লট ?
অর্থাৎ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তরা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার দাবি জানালেও সেটা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ধর্তব্য নয়। কারণ অলি আহাদের মতো ভাষা সৈনিকও তাকে ভাষা আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করতে রাজি হননি।
মূলত ভাষা আন্দোলনের কারণ আর একাত্তরের যুদ্ধের কারণ একই, আর তা হলো অধিকার আদায়। উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে এদেশের মুসলমানদের বঞ্চিত হতে হতো। কারণ চাকরি তখন চলে যেতো ভারত থেকে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে মাইগ্রেট করা বিহারিদের কাছে, যাদের মাতৃভাষা ছিলো উর্দু। এ প্রসঙ্গে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ঘটনার চেয়ে চেতনাই প্রধান’ শীর্ষক একটি কলামে লিখেছেন-
“আজ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কৃতিত্ব নেয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু একটি বিষয় আমরা আড়াল করে রাখছি। বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা করার জন্য লেখক-বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি ও আলোচনা করছিলেন। তাদের সে ভূমিকার মূল্য রয়েছে। কিন্তু আলোচনার বিষয়কে একটি আন্দোলনের বিষয়ে পরিণত করেন শ্রমজীবীরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যখন পোস্টাপিস প্রভৃতির বিভিন্ন কর্মে ইংরেজির সঙ্গে উর্দু লেখা হলো তখনই চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীরা বুঝতে পারেন উর্দু না জানলে তাদের চাকরি থাকবে না।
ঢাকার ইডেন বিল্ডিং বা প্রাদেশিক সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই প্রথম সরকারি কাগজে উর্দু ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন এবং সূচনা ঘটান ভাষা আন্দোলনের। তাদের সেই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বাইরের শিক্ষিত বেকার যুবসমাজ। আন্দোলন একটি মিলিট্যান্ট রূপ নিতে থাকে। কেন বুদ্ধিজীবীরা নন, শ্রমজীবী ও ছাত্র-যুবসমাজ আন্দোলন শুরু করেন? কারণ বিষয়টি শুধু সাংস্কৃতিক নয়, অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। শুধু উর্দু সরকারি ভাষা হলে অল্প শিক্ষিত বাঙালিরা সরকারি চাকরি পাবেন না, সব চাকরি পাবেন উর্দুভাষী মোহাজেররা। একুশের শহীদদের শ্রেণীচরিত্র দেখলেই ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব।” (লিঙ্ক: http://goo.gl/2mPlIw)
এ বিষয়গুলো এদেশের সাধারণ মুসলমানদের বেশি বেশি করে বলাবলি করা দরকার। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরাই বাংলাদেশের সমস্ত অান্দোলন-সংগ্রাম করেছিলো, এখানে হিন্দু ও নাস্তিকদের কোন কৃতিত্ব নেই। অথচ আজ এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যেন গুটিকয়েক সাম্প্রদায়িক হিন্দুই সবকিছু করেছিলো। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করা হচ্ছে হিন্দুয়ানী কালচার ও নাস্তিকতা প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে। এদেশের মুসলমানরা যদি তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের কৃতিত্ব দাবি করতো, তাহলে আজকে এই অবস্থা হতো না।
No comments