বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত
আগে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্যবইয়ের সকল গল্প-কবিতা ভালোভাবে পড়তো না। কিছু হয়ত ভালোভাবে পড়তো, বাকিগুলো পড়তো শুধু পরীক্ষায় উত্তর দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে শুধু প্রশ্ন-উত্তরগুলো পড়ে পরীক্ষার হলে উগড়ে দিতো। কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতি তৈরী করা হয়েছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, যেন তা পড়লে এক বিশেষ ধরনের ‘বিষ’ প্রবেশ করে ছাত্রছাত্রীর ব্রেনে। কিন্তু সেই পাঠ্য যদি ভালোভাবে না পড়ে, তবে ‘বিষ’ প্রবেশ করবে কিভাবে ??
এক্ষেত্রে বিষ প্রবেশের সবচেয়ে সহজপন্থা হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতি। তুমি যাবে কৈ বাপু, তোমাকের জোর করে বিষ খাওয়াবে সৃজনশীল। গল্পকবিতা না বুঝলেও এমন একটা উদ্দিপক জুড়ে দেওয়া হবে, যেই উদ্দিপক দিয়ে পুশ করে দেওয়া হবে প্রয়োজনী থিউরী।
যেমন- নবম-দশম শ্রেনীর বাংলা বইয়ে একটি কবিতা আছে, নাম ‘সাকোটা দুলছে’। কবিতা পড়ে অনেকে কিছু নাও বুঝতে পারে। কিন্তু বইয়ে কবিতার পরে একটি উদ্দিপক নামক ঘটনা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে-
“ঋত্বিককুমার ঘটক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রে দেশভাগের যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। নিজের জন্মস্থানে যেতে হলে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে এই বেদনা তার মত অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই তিনি বলতেন- “বাংলার ভাগ করিবার পারিছ, কিন্তু দিলটারে ভাগ করবার পারো নাই”। (পাঠ্যবই- মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য, শ্রেণী-৯ম-১০ম, পৃষ্ঠা-২৩৬)
“ঋত্বিককুমার ঘটক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রে দেশভাগের যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। নিজের জন্মস্থানে যেতে হলে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে এই বেদনা তার মত অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই তিনি বলতেন- “বাংলার ভাগ করিবার পারিছ, কিন্তু দিলটারে ভাগ করবার পারো নাই”। (পাঠ্যবই- মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য, শ্রেণী-৯ম-১০ম, পৃষ্ঠা-২৩৬)
অর্থাৎ বুঝানো হচ্ছে ৪৭ এর দেশভাগ ঠিক হয় নাই্ । দাও দুই বাংলা এক করে দাও।
এখানে একটি ইতিহাস জেনে রাখা দরকার, ৪৭ এ বাংলার ভাগ কিন্তু মুসলমানরা করে নাই, করেছিলো হিন্দুরা। বাংলার মুসলমানরা বলেছিলো বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে বৃহত্তর বাংলা হোক। কিন্তু বাধ সাথে হিন্দুরা। কারণ তারা জানতো- বৃহত্তর বাংলা হলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। তাই তারা ঢাকার সাথে নয় দিল্লীর সাথে যোগ দেওয়ার জন্য মতামত দেয় । (পড়তে পারেন- জয়া চ্যাটার্জী লেখা “বাঙলা ভাগ হল : হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশ-বিভাগ” বইটি)
কিন্তু ৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর কলকতার হিন্দুরা ভিন্ন গান গাওয়া শুরু করলো। বিভিন্ন নাটক-সিনেমা-সাহিত্যে সস্তা আবেগ সৃষ্টি করে বলতে থাকলো- “বাংলাদেশ ভিন্ন কোন দেশ নয়, বাংলা দুই ভাগ হতে পারে না। দাও দুই বাংলা এক করে দাও। ”
বলাবাহুল্য- “দুই বাংলা এক করে দাও” এটা মানে এই নয় দুই বাংলা এক হয়ে স্বাধীন বাংলারাষ্ট্র হবে, বরং বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের সাথে এক হয়ে ভারতের অঙ্গরাজ্য হবে, এটাই “দুই বাংলা এক করে দাও” শ্লোগানদাতাদের উদ্দেশ্য। এর প্রমাণ-
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরপর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিদের একটি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে আসলে তিনি বলেছিলেন- ‘আমরা সতেরো কোটি বাঙালি একজোট হলে কিনা করতে পারি, ভারত জয় করতে পারি’। বঙ্গবন্ধুর জনৈক সহযোগী আরও খোলাখুলিভাবে বলেন, আপনারা ভারতের অধীন রয়েছেন কেন? আমাদের সাথে মিশে গেলে স্বাধীন হবেন।’ জবাবে কলকাতার বুদ্ধিজীবী দলের নেতা এক সময়ের ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অন্নদা শংকর রায় বলে, ‘আমরা আপনাদের মত শুধু মাত্র বাঙালি নই, আমরা সেই সাথে ভারতীয়’ (অন্নদা শংকর রায়, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী, ওদের আমাদেরও’ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪)। অর্থাৎ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের কখনই ছিলো না এবং এখন নেই। বরং তাদের ইচ্ছে বাংলাদেশ যেন ভারতের ৩০ তম অঙ্গরাজ্য হয়।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরপর পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিদের একটি দল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে আসলে তিনি বলেছিলেন- ‘আমরা সতেরো কোটি বাঙালি একজোট হলে কিনা করতে পারি, ভারত জয় করতে পারি’। বঙ্গবন্ধুর জনৈক সহযোগী আরও খোলাখুলিভাবে বলেন, আপনারা ভারতের অধীন রয়েছেন কেন? আমাদের সাথে মিশে গেলে স্বাধীন হবেন।’ জবাবে কলকাতার বুদ্ধিজীবী দলের নেতা এক সময়ের ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অন্নদা শংকর রায় বলে, ‘আমরা আপনাদের মত শুধু মাত্র বাঙালি নই, আমরা সেই সাথে ভারতীয়’ (অন্নদা শংকর রায়, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী, ওদের আমাদেরও’ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪)। অর্থাৎ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের কখনই ছিলো না এবং এখন নেই। বরং তাদের ইচ্ছে বাংলাদেশ যেন ভারতের ৩০ তম অঙ্গরাজ্য হয়।
যাই হোক, আবার প্রথম কথায় ফিরে আসি। ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন- “দুই বাংলা এক করে দাও” বা আরো সহজভাবে বলতে- “বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য করে দাও” এই থিউরী পড়ানো হচ্ছে বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে।
অথচ দুই বাংলা একত্রিকরণের এই থিউরী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’এর বাংলাদেশের স্বাধীনতাহরণের অন্যতম কৌশল। এ প্রসঙ্গে “আবু রুশদের লেখা- গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা, বাংলাদেশে ‘র’ নামক বইয়ে বলা হয়- “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেভাবে ও যে হারে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবিগণ পঙ্গপালের ন্যায় ঢাকায় আসতে শুরু করেছিলো, অনেকটা সেভাবেই ‘৯১ এর পর তারা আবার এদেশে এসে গার্জিয়ান সুলভ বক্তব্য প্রদান শুরু করে। এছাড়া ভারত থেকেও ভয়াবহ সব বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। এসবের মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য- দুই বাংলাকে একত্রীকরণের প্রচারণা”। (বই-গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা, বাংলাদেশে ‘র’ , লেখক- আবু রুশদ, পৃষ্ঠা- ১৩৫)
কি বুঝলেন ! আগে র’ বাইরে থেকে থিউরী দিতো বাংলাদেশীদের বিভ্রান্ত করার জন্য, আর এখন খোদ বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকে র’ এর থিউরী- “দাও দুই বাংলা এ করে দাও” পড়ানো হয়”। আর সেই থিউরী যেন ছোট বাচ্চাদের মাথায় ভালোভাবে গেথে যায় সেজন্য চালু করা হয়েছে কথিত সৃজনশীল প্রশ্ন, যেন কেউ ইচ্ছা করলেই এড়িয়ে না যেতে পারে। বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তক দিয়ে যে কত বড় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত করা হয়েছে, এই একটি উদাহরণই বোঝার জন্য যথেষ্ট।
No comments