বঙ্গবন্ধু সব সময় মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা ভাবতেন
বঙ্গবন্ধু সব সময় মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা ভাবতেন। তিনি বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে- যেই পাকিস্তানের সাথে ১৯৭১ সালে যুুদ্ধ হলো, সেই পাকিস্তানেই মাত্র ৩ বছর পর (১৯৭৪) গেলেন মুসলিম দেশগুলোর সম্মেলন ওআইসিতে যোগ দিতে ।
মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে, এটা চিন্তা করে তিনি ১৯৭২ সালে ইসরাইলের স্বীকৃতি পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। উল্লেখ্য- পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছিলো- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। স্বাভাবিকভাবে তাই মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে থাকারই কথা । কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বের সে ভুল ভাঙ্গতে থাকে। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা সফরকারী মিশরীয় সাংবাদিক দলের প্রতিনিধি মুহম্মদ হায়কল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলেন- “সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিলো না। এখন মনে হয় আমরা যা ভেবেছিলাম ঘটনাটা আদৌ তা ছিলে না।”
বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক প্রচেষ্টায় তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ বেশকিছু মুসলিম দেশে থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয় । দেশগুলো - ইরাক, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনিশিয়া, মরক্কো, মিশর, সিরিয়া, সুদান, লিবিয়া, কুয়েত, পাকিস্তান (১৯৭৪) , তুরষ্ক (১৯৭৪) ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
বাস্তবে বঙ্গবন্ধু চিন্তা করেছিলেন- যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সাহায্য গ্রহণ ও শ্রমশক্তি রফতানির বিকল্প নেই। মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কতটা তৎপর ছিলেন, সে সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লিখিত ‘ইসলামী বিশ্ব ও বাংলাদেশ’ (প্রকাশ-১৯৮৫) বইয়ের ৩৫-৩৬ পৃষ্ঠায় লেখা হয়-
“.....নিহত হবার (১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫) পূর্ব পর্যন্ত শেখ মুজিব চেষ্টা করেছিলেন ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ়তর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে। এ সময় প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ তার সীমিত সামর্থ্য সত্ত্বেও আবর বিশ্বের জন্য যাবতীয় সহযোগীতা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। তবে উল্লেখ্য যে, ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরবদের সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সহানুভূতি বাস্তব প্রমাণ দেওয়ার প্রথম সুযোগ এসেছিলো ১৯৭৩ এ আরব ইসরাইল যুদ্ধের সময়। এ যুদ্ধের শুরু থেকে বাংলাদেশের জনগণ ইসরাইলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো প্রতিবাদ সভা আর বিক্ষোভ মিছিল। আরবদের প্রতি শুভেচ্ছা নির্দেশ হিসেবে পাঠানো হয়েছিলো ২৮ সদস্যের একটি ডাক্তার দল, এটি ছিলো বিদেশ থেকে পাঠানো সংগ্রামরত আরবদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম ডাক্তার দল।
একই সময় এই যুদ্ধে গুরু দায়িত্ববহনকারী মিশরের জন্য পাঠানো হয়েছিলো ১ লক্ষ পাউন্ড চা। উপরন্তু আরবদের পাশপাশি যুদ্ধ করার জন্য ৫ হাজার সদস্য বিশিষ্ট একটি সেচ্ছা যোদ্ধাবাহিনী, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন ভূতপূর্ব মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের এ ভূমিকা আবরদের জন্য ছিলো বিমুগ্ধ বিষ্ময়। মনে রাখা দরকার বাংলাদেশ তখনও প্রধান ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি পায়নি। অপরদিকে আরবদের এ মরণপন সংগ্রামের প্রতি পাকিস্তানের নিস্পৃহতা ও ঔদাসীন্য ছিলো বিপন্ন বিষ্ময়। কাজেই আরবদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগতে সময় লাগেনি। এ যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের একজন সাংবাদিককে মিশরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন- আমরা এতদিন পাকিস্তানের প্রচারণা বিশ্বাস করে এসেছি এবং আপনাদের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম। এখন আমরা উপলব্ধি করছি যে, ইয়াহিয়া চক্রের দ্বারা সংগঠিত অপরাধকে প্রধানমন্ত্রী জনাব ভুট্টোরও যোগসাজশ ছিলো।’ একই সময় আরেকজন মিশরীয় কূটনীতিবিদ মন্তব্য করেছিলেন- “আপনাদের প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজীব) একটি ব্যাপক যুদ্ধে একটিও গোলা-অস্ত্র ব্যবহার না করে আরব বিশ্বসহ প্রায় অর্ধেক আফ্রিকা জয় করে নিয়েছেন।” এ মন্তব্যে অতিরঞ্জন হলেও বাস্তবতার অভাব ছিলো না। কারণ আরব বিশ্বে সে সময় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এমন স্থান করে নিয়েছিলো যে একজন সাধারণ মানুষও শেখ মুজিবুরের নাম জানত। ” (সূত্র: ইসলামী বিশ্ব ও বাংলাদেশ. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, প্রকাশকাল্ - ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫, পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৬)
উপরের ঘটনাগুলো আলোচনা করলাম এই কারণে, বঙ্গবন্ধুর নিজেই মুক্তিযুদ্ধের পুরোধা হয়ে দেখিয়ে গেছেন, কিভাবে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু আজকে যারা বঙ্গবন্ধুর চেতনার কথা বলে তারা এ বিষয়গুলো মোটেই মেনে চলে না, বরং উল্টো করে থাকে। যেমন- খোদ আওয়ামীলীগ। এ দলটি নিজেই বঙ্গবন্ধুর চেতনা থেকে সরে এসেছে, মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি তারা তেমন গুরুত্ব দেয় না। আবার আজকাল হাটে-মাঠে কিংবা শাহবাগ মোড়ে অনেক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তৈরী হয়েছে, যারা বঙ্গবন্ধুর চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে যাচ্ছে। এরা মুসলিম বিশ্বের সাথে কিভাবে সম্পর্ক খারাপ করতে হয় সেই উস্কানি ছড়িয়ে দেয়, মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে টুইট করতে জনগণকে উস্কানি দেয়। অথচ একই সময় আমেরিকা-মোসাদ সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণে প্রচারণা চালায়, আইএস অজুহাতে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে, কিন্তু ঐ চেতনাওয়ালারা তার বিরুদ্ধে টু শব্দটা পর্যন্ত করে না।
ঐ সকল কথিত চেতনাবাজদের যদি সত্যিই দেশপ্রেম থাকতো, তবে মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে দুই-একটা বিষয় নিয়ে অযথা আক্রমনাত্মক না হয়ে আমেরিকা-ইসরাইলের বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আগে প্রতিবাদমূখর হতো, রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলনে নামত। কিন্তু বাস্তবে তার ছিটেফোটাও দেখা যায় না।
No comments