বাংলাদেশে গরু জবাই করার রীতি অর্জনে পূর্বপুরুষদের ত্যাগ
আপনি জানেন কি ? বাংলাদেশে গরু জবাই করার রীতি আপনার পূর্বপুরুষদের বেশ সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছিলো ??
বাংলাদেশে বর্তমানে কোরবানী ঈদে যে গরু জবাই করার রীতি পাওয়া যায়, তা কিন্তু এমনি এমনি লাভ করা হয়নি, বরং বাংলার মুসলমানদের বেশ করে কষ্ট করে এই রীতি অর্জন করতে হয়েছিলো। ইতিহাস সবার জানা, সিলেট মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে এসেছিলো গরু জবাইকে কেন্দ্র করেই। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে একটি গরু জবাইকে কেন্দ্র করে সিলেটের ইতিহাস রচিত হয়েছিলো। তবে শুধু সিলেট নয় বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই গরু জবাই করতে দিতো না হিন্দু ধর্মালম্বীরা, এমনকি ৫০ বছর আগেও এ গরু জবাই নিয়ে মুসলমানদের বিধি নিষেধ আরোপ করা হতো বাংলাদেশে। আসুন সে সব ইতিহাস জেনে নেই......
১) লেখক মুনতাসীর মামুন তার "বাংলাদেশের উৎসব" নামক বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখে- "আজকে আমরা ইদ-উল-আজাহায় গরু কোরবানীর অনায়সে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানী দিয়ে ফেলি আশি একশো দুরে থাকুক পঞ্চশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না ৷ আজকের প্রজন্ম হয়ত অবাক হবে যে এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে ৷ এবং কোরবানী বিশেষ করে গরু কোরবানী দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে ৷ "
২) ১৮৮২ সালে দায়নন্দ সরস্বতী ভারতে " গো হত্যা নিবারনী " সভা স্থাপন করলে শুরু হয়েছিল বিতর্ক ৷ "গো হত্যা" বা গরু কোরবানীর বিপক্ষে এ সভা থেকে ভারত জুড়ে হয়েছিল প্রবল প্রচার ৷ ১৮৮৭ সালে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় কংগ্রেস মাদ্রাজ অধিবেশনে এ পরিপ্রেক্ষিতে উত্থাপন করেছিলেন প্রস্তাব ৷ ফরিদপুর ও বিভিন্ন অঞ্চলেও এ নিয়ে প্রচার শুরু হয়েছিল ৷ তখন এর বিরোধিতা করতে মুসলিমদের বিভিন্ন সভা বা আঞ্জুমান সমূহ এগিয়ে এসেছিল ৷ বিত্তবান হিন্দুদের এ প্রচারনার সমর্থনে এসেছিল স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা ৷
৩) ১৯শ‘ শতকের শেষ দিকের অবস্থার একটি বিবরন পাওয়া যায় ইবনে মাযুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনী 'আমার সংসার জীবন ' এ ৷ তিনি লিখেছিলেন " গোবিন্দপুর হরিশঙ্করপুর, সনাতন, গোপীনগর, আমলা, গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন হিন্দু জমিদারের জমিদারীভুক্তি ; সেখানকার মুসলিমগন বহুকাল অবধি গরু কোরবানী করতে বা গরু জবেহ ও উহার গোসত ভক্ষন করিতে পারিত না ৷ কেহ করিলে তার আর রক্ষা ছিল না ৷ জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগন কোরবানীদাতা ও হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্রহার ও নানা অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট জরিমানা আদায় করিত ৷ সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ঐ অঞ্চল হইতে গো কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল ৷ " (তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশের উৎসব , লেখকঃ মুনতাসীর মামুন, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ৩৩ )
৪) গরু কোরবানীকারিদের সে কালে রাষ্ট্রীয় ভাবে জেল জরিমানা করা হতো। ১৮৯৫ সালে দিকে জানা যায় ময়মনসিংহের অশ্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদার ঈদ উল আজহার গরু কোরবানীর জন্য বেশ কিছু মুসলমানকে জরিমানা করেছিল ৷
৫) গরু কোরবানী করলে মামালা খেতে হয় মুসলমানদের। ১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন কোরবানী উপলক্ষে গরু কোরবানী দিয়েছিল ৷ এর ফলে জৈনক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল ৷ অভিযোগ ছিল মুসলমানরা প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবেহ করেছে এবং বদ্ধ পানিতে মাংশ ধুয়ে পানি অপবিত্র করেছে ৷ জেলা হাকিম ছিলো জগদীশচন্দ্র সেন ৷ সে তিনজন মুসলিমকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দুজনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ ও পনের টাকা জরিমানা করেছিল ৷ " (তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশের উৎসব , লেখকঃ মুনতাসীর মামুন, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ৩৪ )
৬) তৎকালিন সংবাদপত্র গুলোও বিভক্ত হয়ে পক্ষে বিপক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করতে ছাড়েনি ৷ ১৯০১ সালে মাওলানা আকরাম খাঁ তার সম্পাদিত মোহম্মদী পত্রিকায় কোরবানীর পক্ষে লেখাতে বলে যে- মুসলিমরা সে রুপে কোরবানী পালন করে , হিন্দুরা এরুপ "গো মেঘ যঞ্জ " পালন করত ৷ " সঞ্জীবনী " নামক পত্রিকায় তার এই উক্তির বিপক্ষে লেখা হয় যে ৷ "ঐ সব প্র়াচীন তত্ত্ব কেন প্রকাশ করা হইতেছে? বিন্দুতে গো মাংস ভক্ষন করার জন্য? এদেশে গো-মাংস চলবে না ৷; " (তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশের উৎসব , লেখকঃ মুনতাসীর মামুন, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী পৃষ্ঠা ৩৭ )
ইতিহাস বলে দিচ্ছে, বাংলায় গরু কোরবানীর রীতি খুব কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে মুসলমানদের। আবার হিন্দুরাও মুসলমানদের গরু কোরবানী বন্ধে নানা প্রকার প্রয়াস চালিয়েছে, প্রতিনিয়ত বাধা দিয়েছে, কখনই বসে থাকেনি। বর্তমানেও যে বাংলাদেশের হিন্দুরা সে পথ থেকে সরে এসেছে তা বলা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে কোরবানী বিরোধী যে অপপ্রচার ও কার্যক্রম চলছে তা যে প্রশাসন ও মিডিয়ায় লুকিয়ে থাকা হিন্দুদেরই কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
No comments