বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি যেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ না হয়
ভারতের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিই হচ্ছে পাকিস্তানের বিরোধীতা করা। পাকিস্তানের বিরোধীতা করলেই ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদ পূর্ণ হয় । বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে কিন্তু সে রকম নয়। কারণ শুরুতে পাকিস্তান (মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মত বাংলাদেশী নেতারাই। খোদ বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) পড়লে দেখা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কতটুকু আকাঙ্খিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অন্যায় নিপীড়নের কারণে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং স্বাধীনভূমি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু এর মানে এই নয় বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদের সাংঘর্ষিক কিছু হয়, তবে অবশ্যই সেটার মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল নেতাদের (শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান) ভুল হিসেবে সাবস্থ হয়। যা অবশ্যই ইতিহাস বিকৃত, এবং শীর্ষ নেতাদের নামে অপবাদ।
সাম্প্রতিক সময়ে জামাত নেতাদের ফাসি’র পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তার নিন্দা জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সুশীল গোষ্ঠীর অনেকেই বলছেন- বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধচারণ হয়েছে। এটা নিয়ে অনেকেই নিন্দা জানিয়েছে।
বিষয়টি মেনে নিলাম। কিন্তু একই সাথে এটাও মনে রাখা উচিত, বর্তমানে যারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমের বিরোধীতা করছে তাদের বিরুদ্ধচারণ করাও কিন্তু দেশপ্রেমীদের দায়িত্বের মধ্যে পরে।যেমন- ভারত প্রতিদিন বাংলাদেশ সীমান্তে মানুষ মারছে, ভারতীয় শীর্ষ নেতারা মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশ দখলের হুমকি দিচ্ছে, মোদি অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছে, বাংলাদেশের হিন্দুরা মোদির সাথে গোপন মিটিং করেছে, এগুলোও কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের লঙ্খন পর্যায়েই পরে। পাকিস্তানের বিবৃতির কারণে পাকিস্তানের বিরোধীতা করার সাথে সাথে এগুলোর বিরোধীতা করাও কিন্তু জরুরী। কিন্তু যখন কথিত সুশীল সমাজ শুধু পাকিস্তান বিরোধীতার সময় রাস্তায় নামে, কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ করে, চোখ বন্ধ করে দেখেও না দেখার ভান করে, তখন কিন্তু তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে? প্রশ্ন জাগে- আদৌ এসব সুশীল সমাজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বার্বভৌমত্বকে ভালোবাসে নাকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়াই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য ??
উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন- তিনি পাকিস্তানের অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যাবেন না। এছাড়া বেলুচিস্তান ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জ্ঞাপন করেছে বলে শুনেছি।
এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ,
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৩ বছর পর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান গিয়েছেন, পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সাথে গলায় গলা জড়িয়ে ছবি পর্যন্ত তুলেছেন। আজকে যারা পাকিস্তান বিদ্বেষকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বলে প্রচার করতে চান, তারা কি তাহলে বঙ্গবন্ধুর থেকে অধিক দেশকে ভালোবাসে ? আর যদি হয়েই থাকে, তবে তারা কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে সম্পর্ক করতে যায় ?? কারণ এ দুটো দেশ কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো। আর ভারতের বিজেপির সাথেও কিন্তু সম্পর্ক করার কারণ থাকতে পারে না। কারণ বিজেপি (তৎকালীন ভারতীয় জনসংঘ) কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো না, বিরুদ্ধে ছিলো (বিজেপি বা ভারতীয় জনসংঘ মার্কিনপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী হওয়ায় বিজেপিও বিরোধীতা করেছে। কিন্তু রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় রুশপন্থী ভারতীয় কংগ্রেস পক্ষে ছিলো) ।
বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় ও পররাষ্ট্র নীতিতে এটা স্পষ্ট,
বাংলাদেশ যতটুকু না বাংলাদেশী জাতীয়তা ও স্বার্থ অনুসরণ করছে, তার থেকে ঢের অনুসরণ করছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও স্বার্থকে, ভারত যেভাবে বলছে, তার হুবুহু অনুসরণ হচ্ছে। যদি পাকিস্তানের বিরোধীতা করতেই হয়, সেটা যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের স্বার্থেই করা হয়, কিন্তু ভারতের দিকে অধিক ঝুকে পরার কারণেই যেন শুধু পাকিস্তান বিরোধীতা না হয়।
আমাদের সতর্ক থাকার প্রয়োজন-
ভারতী চেতনার বাস্তবায়ন যদি বাংলাদেশের দেশপ্রেম বলে চালনো হয় তবে খুব শিঘ্রই কিন্তু ফাকা বুলি জনগণের কাছে ধরা পরে যাবে। তখন ইচ্ছা অনিচ্ছায় আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা চেতনার কোন মূল্য থাকবে না। এর জন্য কিন্তু বতর্মান চেতনার ফেরিওয়ালারাই দায়ী থাকবে।
No comments