স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন
ছোট বেলায় বিজয় দিবস এলে আমার মনে আনন্দের জোয়ার বইতো। আমার কাজ ছিলো ১০ পয়সা দামের কাগজের পতাকা কেনা। ২০ টাকা দিয়ে ২শ’ পতাকা কিনতাম। সাথে ১০ টাকার মাঝারি সাইজের একটা কাপড়ের পতাকাও কিনতাম।
বাসায় এসে রান্নাঘরের আটার কৌটা থেকে আটা নিয়ে তাতে পানি মিশিয়ে লেই (আঠা) বানাতাম। এরপর সেই ‘লেই’ দিয়ে আম্মার কাপড় সেলাইয়ের সুতার মধ্যে কাগজের পতাকাগুলো লাগাতাম। একটা এদিক, আরেকটা ওদিক। এরপর সুতায় বাধা সেই কাগজের পতাকা দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের ব্যালকোনি সাজাতাম। কাপড়ের পতাকা টাঙ্গানোর জন্য আমার আলাদা কোন লাঠি ছিলো না। বেশিরভাগ সময় খাটের কাঠের স্ট্যান্ড খুলে আগায় পাতাকা লাগাতে হতো।
ব্যালকোনি সাজানো শেষ হলে ছাদে উঠতাম। দেখতাম- আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে পুরো ছাদকে হাজার হাজার কাগজের পতাকা আর কাপড়ের পতাকা দিয়ে সাজিয়েছে। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় সব বাড়ির ছাদই ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে সাজিনো দেখতাম। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছে সেটা ভাবতেই আমার কেমন জানি আনন্দ লাগতো, আর সেই আনন্দের প্রকাশ পেতো লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে সাজানোর মাধ্যমে।
তবে কাগজের পতাকা দিয়ে যখন সাজাতাম, তখন একটা বিষয় খুব ভালো করে খেয়াল রাখতাম। অনেক সময় কাগজের পতাকার মধ্যে সবুজ অংশ প্রিন্ট আসতো না। এতে পতাকার সবুজ অংশ হয়ে যেতো সাদা, মধ্যে লাল বৃত্ত। কে যেনো বলেছিলো- “এই পতাকা জাপানের পতাকা। এই পতাকা লাগানো কঠিন অপরাধ।” এই কথাটা সেই সময় আমার মনে খুব ধরেছিলো। ভাবতাম- “ঠিকই তো, বাংলাদেশের আকাশে বিদেশী পতাকা উড়বে কেন ?”। ঐ ছোটবেলায় সবুজ ছাপা না পরায় সাদার মধ্যে লাল বৃত্তের সেই ‘জাপানি পতাকা’ সুতায় আঠা দিয়ে লাগাতে নিজেকে কেন জানি ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ মনে হতো। তাই সেই কাজ আমি করতে পারিনি।
এখনও ১৬ই ডিসেম্বর আসে। শুনেছি এখন নাকি দেশের ছাদগুলো আর আগের মত তেমন পতাকা দিয়ে সাজায় না নতুন প্রজন্ম। তবে ১৬ই ডিসেম্বরে নিজ দেশের পতাকা দিয়ে না সাজাক, ফুটবল বিশ্বকাপ আসলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে ঠিকই বাংলাদেশের ছাদগুলো সাজানো হয়। কে কত বড় পতাকা উড়াতে পারে, সে কত বড় বিদেশী পতাকা দিয়ে বাড়ি সাজাতে পারে, সেটা নিয়েও প্রতিযোগীতা বেধে যায়।
গত ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান ঐ জেলার সমস্ত বিদেশী পতাকা নামানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঐ নির্দেশনার পেছনে অবশ্য আইনগত বৈধতাও ছিলো। বাংলাদেশ পতাকা বিধিমালা ১৯৭২-এর বিধি ৯(৪) অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে কোনো ভবনে বা যানবাহনে কোনো বিদেশি পতাকা উত্তোলন করা যাবে না। (http://bit.ly/2BdEsZ1)
কিন্তু অতি দুঃখজনক বিষয়, যশোর জেলা প্রশাসকের ঐ নির্দেশনার মাত্র ৪ দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন- “ ফুটবল খেলার বিদেশী পতাকার উপর কোন বিধি নিষেধ দেয়া যাবে না। যে যে দলের সমর্থক সে দলের পতাকা ওড়াতে পারবে।” (http://bit.ly/2CjBCki)
এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার গণজোয়ার বয়ে গিয়েছিলো। সে সময় ছোটবেলার সেই ‘জাপানের পতাকা’র কথা স্মরণ হয়েছিলো আমার। ভেবেছিলাম -“এটা কিভাবে সম্ভব, নিজ দেশে অন্যের পতাকা লাগনো ! নিজ দেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব ও আইনের থেকে ফুটবলপ্রেম বেশি মূল্যবান হয়ে গেলো ?”
শুনছি, আগামী জুন মাসে নাকি আবার বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হবে। তারমানে খুব শিঘ্রই বাংলাদেশের ছাদ আবার ভরে উঠবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায়। ১৬ই ডিসেম্বর ছাদে নিজ দেশের পতাকা দেখতে না পান, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার বন্যা আপনার চোখ এড়াবে না। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে কেবল একটি কথাই মনে পরে- “স্বাধীনতা অর্জনের থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা আসলেই কঠিন।”
========================================
-----------------------------------------------------------------------
(https://www.facebook.com/Noyon-Chatterjee-6-202647270140320/)
-----------------------------------------------------------------------
-----------------------------------------------------------------------
No comments